ডিমের ঝোল
-সুতপা মন্ডল
তোমাদের কতবার বারণ করেছি তাও আজ আবার আমায় ডিমের ঝোল দিয়েছো?
একটা কথা এতবার করে কেন বলতে হয়? জানো তো আমি ডিমের ঝোল খাই না, খেতে বসে ঝোলের বাটি দেখে রেগে যান শশী বাবু।
বাবা, ওটা আপনার না, ওটা আপনার ছেলের, ভুল করে বাটিটা আপনার জায়গায় রাখা হয়ে গেছে। মা আপনার জন্য দুধের বাটি আনছেন।
– বাড়ির ছেলেদের খাবার শেষে শাশুড়ি বৌমা দুজনে খেতে বসে গল্প করার সময় উষশী শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা মা, বাবা কেন খান না ডিম?”
– কি জানি কেন যে খান না! বিয়ের পর থেকেই দেখছি কোনোদিন খাননি, অবশ্য আমাদের খেতে কখনো মানা করেননি, বাড়িতে জিজ্ঞাসা করার মতন কেউ তো ছিল না, তোমাদের পিসি বলেন ও ছোট থেকেই দেখেনি দাদাকে ডিম খেতে।
জানো তোমার বাবাকে অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছি কেন খেতে চান না, কিছু অসুবিধে আছে কিনা, উনি কখনোই উত্তর দেননি, বলেছেন এটা নিয়ে কথা বলো না, রাগারাগি হবার ভয়ে আমিও চুপ করে গেছি।
খাবার টেবিলে বসে শাশুড়ি বৌয়ের সব কথা কানে যায় শশীবাবুর। মনে ভাবেন, এই কষ্টের কথা তোমাদেরকে বলতে চাই না।
আমার ভিতরের চাপা কষ্টটা তোমাদের দেখাতে চাই না। তাতে তোমাদেরও কষ্ট বাড়বে বিশেষ করে আমার ছোট বোনটার। সে তো তার ছোটদাকে ঠিকমতো চেনেই না, কিন্ত তবু নিজের দাদার কথা শুনলে মনখারাপ হয়ে যাবে।
বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে ভাবতে থাকেন, যেন দেখতে পাচ্ছেন নিজের হাফপ্যান্ট পরা ছোটবেলাটাকে।
ছোট সংসার ছিল গ্রামে, মা-বাবা আর আমরা দুই ভাই, ছোট্ট বোন পরী।
আমরা ঠিক গরীব ছিলাম না, মোটামুটি সচ্ছল পরিবার বলা হতো আমাদের।
তখন তো চাইলেই সবকিছু হাতের কাছে পাওয়া যেত না, পুকুরে মাছ ধরা হলে মাছ আসতো বাড়িতে, অবশ্য কখনো কখনো আমরা দুই ভাই মিলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। দুপুরবেলা মাকে লুকিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে কতবার মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছি।
মাংস অবশ্য হত মাঝেমাঝে, বাড়িতে মুরগি ঢোকা মানা ছিল, পাঁঠার মাংস সব সময় পাওয়া যেত না, তবে যেদিনই গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে পাঁঠা কাটা হতো আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেত বাবার এরকম বলা ছিল।
সেদিন আমাদের দুই ভাইয়ের খুব আনন্দ হতো, পরী তখন খুবই ছোটো, কথা বলতে শেখেনি, কিছু বুঝতো না। আমাদের সেদিনের আনন্দ এখনকার ছোট ছেলেদেরকে বোঝাতে পারবো না।
রাতের বেলা আলুপোস্ত অথবা একটা সবজি আর ডিমের ঝোল। মুরগির ডিম বাড়িতে আসত না কখনো। মা কতকগুলো হাঁস পুষেছিলেন, গ্রামের অনেক বাড়ি থেকেও ডিম বিক্রি করে দিত মা কিনে রাখতেন, ডিম আমাদের দুই ভাইয়ের ভীষণ পছন্দের ছিল। তার ওপর মায়ের হাতে বানানো ডিমের ঝোলের স্বাদ ছিল অসাধারণ।
আমরা দুই ভাই খেতে বসে ডিমটাকে লাড্ডুর মতো একবার থালার এদিকে রাখতাম তো আবার একবার ওদিকে। ঝোল তরকারি মেখে পুরো ভাত খাওয়া হয়ে যেত, কিন্তু ডিম পুরো থালা ময় ঘুরে বেড়াতো।
সবার শেষে ওটাকে একটু একটু করে ভেঙে খাওয়া। প্রথমে ডিমের সাদা অংশটা খেয়ে নিয়ে কুসুমটা রাখা থাকতো থালায়, গোটা থালা ফুটবল গ্রাউন্ড আর কুসুমটি ছোট্ট ফুটবল, গোল গোল করে ঘুরছে। আবার নিজের খাওয়া হয়ে গেলে একজন আরেকজনের থেকে মেরে খাওয়ার চেষ্টা করতাম তাই নিয়ে মায়ের কাছে খুব বকুনি খেতাম।
কি জানি তারপর হঠাৎ কি হল? পরপর কয়েক বছর হয়তো ফসল ভালো হয়নি, বাবার আয় হয়তো একটু কমে গিয়েছিল, বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন ডিম আসার বদলে সপ্তাহে দু- তিন দিন আসতে থাকলো। কোনো কোনো দিন মা আমাদের দুই ভাইকে একটা ডিম দু’ভাগ করে দিতে লাগলেন। ভাই এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না, বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারতো না। তবু সেদিন কি হয়েছিল কে জানে?
সেদিনও বাড়িতে মা ডিমের ঝোল রান্না করেছিলেন, আমাদের দুই ভাইকে একটা ডিম অর্ধেক ভাগ করে দিতেই ভাই বলে ওঠে ‘আমি আধটা ডিম খাব না, আমার গোটা ডিম চাই, আগে তো গোটা ডিম দিতে এখন দিতে পারো না?’
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, বলেছিলাম তুই আমারটা নিয়ে নে তাহলেই তো গোটা হয়ে যাবে। আমি না হয় আজকে খাবো না। সেদিন কোনো কথা শুনতে সে রাজী হচ্ছিল না, শেষে বাবা এসে বকাবকি করতে চুপচাপ খেয়ে শুতে চলে যায়।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, ভাই আমার পাশে নেই, মা বাবাকে জানাতে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি, কিন্তু না, সে যে কোথায় চলে গেল কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
গ্রামে, আশেপাশের গ্রামে এমনকি সমস্ত পুকুরে জাল নামিয়ে খোঁজা হয়েছিল ভাইকে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি।
বাবা একদম চুপ হয়ে গেছিলেন, মা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতেন।
সেদিন থেকে বাড়িতে ডিম আসা বন্ধ হয়ে গেল, মা বাবা আমি কেউই ডিম খেতে পারতাম না, একটা ডিমের জন্য ভাইটাই হারিয়ে গেল!
কয়েক বছরের মধ্যেই আমাকে আর পরীকে একা করে দিয়ে মা-বাবা একে একে চলে গেলেন। নিজের পড়াশোনা, পরীকে বড় করা সব দায়িত্ব আমার ওপর। কোনক্রমে নিজের পড়াশোনা শেষ করে গ্রাম সম্পর্কিত এক কাকার সাহায্যে একটা চাকরি পেয়েছিলাম।
শহরে আসার কিছুদিন পর গ্রামের সমস্ত জমি জায়গা বিক্রি করে এই বাড়িটা বানিয়ে সংসার, বোনের বিয়ে হয়েছে। সেও সুখী হয়েছে।
কিন্তু এখনো ডিমের ঝোল দেখলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে একবার যদি ভাইটাকে খুঁজে পেতাম ।
-আমার অফিসের নতুন বসকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে হবে মা, অফিস থেকে এসে বলে অমিত।
-কেন রে?
-উনি বহু বছর বিদেশে ছিলেন, বাঙালি খাবার প্রায় ভুলে গেছেন অথচ খেতে খুব ভালোবাসেন। আজ আমাদের সাথে বসে লাঞ্চ করছিলেন, তোমার হাতের সবজি খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কথায় কথায় অবশ্য বললেন ওনার মা খুব ভালো রান্না করতেন। আমি বললাম আপনাকে একদিন আমাদের বাড়ি আসতে হবে।
শুনে খুব খুশি হলেন বললেন- নিশ্চয়ই আসবো।
-তাহলে এক কাজ কর সামনের রবিবার ওনাকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ কর।
-কি বৌমা, তুমি কি বলছো? সেটা ভালো হবে না?
-হ্যাঁ মা তাই ভালো রবিবার ওনাদের ডাকো সন্ধ্যেতে, আমরা সব অ্যারেঞ্জ করে ফেলবো, ভালোই হবে তোমার বসের সাথে আমাদের আলাপ হয়ে যাবে।
-তোর বসের কি নাম?
-সি.কে .রায়
-আমরাও রায় আর উনিও রায়, আসতে বলে দে ভালই হবে।
রবিবার সন্ধ্যাবেলা সস্ত্রীক সি.কে. রায় আসার পর অমিত সবার সাথে আলাপ করাতে থাকে।
-বাবা উনি আমার বস।
বসের মুখের দিকে অনেকক্ষণ থেকে তাকিয়ে থাকেন শশী বাবু।
সবাই গল্প করছেন, কিন্তু শশীবাবুর মনে কোনো সুখ নেই, তিনি বারবার মনে করতে চাইছেন এনাকে কোথায় দেখেছেন, ভীষণ চেনা লাগছে ।
মিস্টার সি. কে. রায়-ও বারবার তাকে দেখছেন।
শেষে বলেই ফেললেন, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো! আপনাকে আমার ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে।
-বাবা তুমি ওনাকে কোথায় দেখবে? উনি সারাজীবন বাইরে ছিলেন।
হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো মা বাবার ফটোটা দেখে সি.কে. রয় বলে ওঠেন “এনারা!”
-আমার মা-বাবা।
-দাদা..আমাকে চিনতে পারছিস না! আমি তোর চাঁদু।
দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেন, দু’জনে আনন্দে আত্মহারা।
কান্নাকাটির অভিমানের পর্ব শেষে শশী বাবু বলেন, তুই কোথায় ছিলিস তোকে কত খুঁজেছি?
সব বলবো দাদা, তোকে যখন পেয়েছি আর হারাবো না । কিন্তু আমাদের বোন পরী, পরী কোথায়?
ভালো আছে, ওর বিয়ে হয়েছে খুব সুখে আছে। কিন্তু তুই বল তুই কোথায় ছিলিস?
-বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছিলাম স্টেশনের দিকে। ভোরবেলা প্রথম যে ট্রেনটা পেলাম তাতে উঠে পড়লাম, টিকিট কাটিনি। চেকার এসে টিকিট চাইতেই মুশকিলে পড়লাম, ভাগ্য খুব ভালো ছিলো, আমার সহযাত্রী ছিলেন এক নিঃসন্তান দম্পতি, তারা ফাইন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
আমাকে ওনার সঙ্গে করে নিয়ে চলেন ওনাদের বাড়ি। অবশ্য বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ির কথা আমি ওনাদের কিছু বলিনি।
ওনারা আমাকে নিয়ে গিয়ে সন্তান স্নেহে মানুষ করতে থাকেন, অনেকবার বলেছিলেন একবার অন্তত মা-বাবার কাছে যেতে, তখন আর রাগ ছিল না লজ্জা লাগতো, তাই ভেবেছিলাম চাকরি পেয়ে একবারে যাব মা-বাবার কাছে, একদম গিয়ে অবাক করে দেবো। চাকরি পাবার পর গিয়েছিলাম গ্রামে কিন্তু ততদিনে তোমরা গ্রাম ছেড়েছো। গ্রামে আমাকে কেউ চিনতে পারলো না, আসলে ছোটবেলায় ঘর ছেড়ে ছিলাম তো তাই কেউ আর চিনতে পারলো না।
বাড়িও গিয়েছিলাম গিয়ে দেখলাম ওই বাড়িতে গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাই থাকেন যাকে আমি চিনি না।
অনেকের কাছে তোমাদের ঠিকানা চাইলাম কিন্তু কেউ দিতে পারল না। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলাম।
তারপর চলে গেলাম বিদেশে।
আজ এই ভাবে তোমাকে পাবো ভাবতেই পারিনি।
-সত্যি রে, কি আনন্দ হচ্ছে, মা বাবা থাকলে কত খুশি হতেন, তোকে হারিয়ে খুব মনোকষ্টে ছিলেন। যাক আর আমি তোকে কোথাও যেতে দেব না। বৌমা আজ তোমাদের কি রান্না হয়েছে?
-বাবা মাছ মাংস সব রান্না করেছি।
-ডিম, ডিম রান্না করোনি!
-না বাবা, আপনি তো ডিম খান না।
পাশ থেকে চন্দ্রকান্ত বাবুর স্ত্রী বলে ওঠেন, ভালো করেছেন আমার উনিও কিন্তু ডিম খান না।
দুই ভাই জোরে হেসে ওঠেন।
-বৌমা কাল ভালো করে ডিমের ঝোল রান্না করো আমরা দুই ভাই কবজি ডুবিয়ে খাবো।
সবাই একসাথে বলে ওঠে “কিন্তু তোমরা তো ডিম খাও না!”
“ভাইয়ের সাথে সাথে ডিম হারিয়ে গেছিল” সবাই হেসে ওঠেন।